আওয়ামী দোসর গণপূর্তের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শেখর চন্দ্র বিশ্বাস ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির করেও বহাল তবিয়তে
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন গুরুত্বপূর্ণ অধিদপ্তর গণপূর্ত অধিদফতরে গত ১৬ বছর ধরে গড়ে উঠা লুটপাটের সহযোগী বিগত সরকারের কর্মকর্তাদের বিতাড়িত করার কার্যকর পদক্ষেপ শুরু করেছে সরকার।
কিন্তু মাঝখানে এসে মন্ত্রণালয় থমকে যায় অধিদপ্তরের প্রকৌশলীদের সিন্ডিকেটের হাতে। এখনোও প্রকৌশলী সদস্যদের সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে থাকায় তাদেরকে বদলি করতে পাছেন না অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয়। তারা এখনও বহাল তবিয়তে অফিস করছেন। কেউ বা বছরের পর বছর পোস্টিং ঢাকায়। তাও বা গুরুত্বপূর্ণ সার্কেলে দায়িত্ব পালন করছেন। কেউ বা ঘুরেফিরেই আবার ঢাকায় বদলি হচ্ছেন।
গণপূর্তের সাবেক মন্ত্রী/ ও সচিব এবং প্রকৌশলীদের নামেও একাধিক মামলা হয়েছে। সেই সাবেক মন্ত্রী/ ও সচিব এবং প্রকৌশলীদের আস্থাভাজনরা এখনও অধিদপ্তর/ সার্কেলে আরাম আয়েশে অফিস করছেন। সাবেক ও বর্তমান প্রধান প্রকৌশলীদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি করে গেছে। নিয়োগ বানিজ্য, বদলী বানিজ্য, টেন্ডার বানিজ্য করে শত শত কোটি টাকা আয় করেছেন তাঁরা।
গণপূর্ত অধিদপ্তরে যে কয়েকজন প্রভাবশালী তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী অনিয়ম ও দূর্নীতি করে নামে বেনামে দেশ ও বিদেশে শত শত কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন শেখর চন্দ্র বিশ্বাস তাদের মধ্যে একজন। ঘুরে ফিরে ঢাকার এক ডিভিশন থেকে আরেক ডিভিশনে বদলি হন! ঢাকা ছাড়তে হয়নি, এমনকি ঢাকা যেন তাকে ছাড়তেই চাই না।
সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার সলস গ্রামের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রফুল্ল চন্দ্র বিশ্বাসের ছেলে শেখর চন্দ্র বিশ্বাস। বিসিএস ২৪ তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা ২০০৫ সালে চাকরিতে যোগদান করেন। চাকরিতে যোগদানের পর থেকেই নীতিভ্রষ্ঠ হয়ে টাকা ইনকামের নেশায় হয়ে ওঠেন দূর্নীতির বরপুত্র।
অভিযোগ উঠেছে সিরাজগঞ্জের সাবেক প্রভাবশালী সংসদ সদস্য তানভীর ইমাম ( এইচ টি ইমামের সন্তান শেখ হাসিনার সাবেক রাজনৈতিক উপেদষ্টা) তার নিজ এলাকার সংসদ সদস্য হওয়ায় তার প্রভাব খাঁটিয়ে বাগিয়ে প্রাইজ পোষ্টিং ।
তিনি ২০১৮ সালে নির্বাহী প্রকৌশলী (ই/এম), পিডব্লিউডি ই/এম উড ওয়ার্কশপ বিভাগ, ঢাকা পদে কর্মরত ছিলেন। ২০১৮ সালের একটি সরকারি নথি থেকে জানা যায় যে, তিনি এই পদে কর্মরত থাকাকালীন সপরিবারে বিদেশে ভ্রমণের জন্য ছুটি নিয়েছিলেন, মুলত তিনি ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নিশি রাতের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে (শেখ হাসিনা আর ক্ষমতায় আসবে না ভেবে) ভ্রমণের নামে অবৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করে আসেন।
নির্বাচনের পর স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার গঠন করলে তিনি আবারো দেশে ফিরে এসে দূর্নীতিবাজ সাবেক সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ও শাহাদাত হোসেন ও তৎকালীন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম কে ম্যানেজ করে বাগিয়ে নেন আওয়ামীলীগের তীর্থস্হানখ্যাত গোপালগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী (ই/এম), গণপূর্ত ই/এম পিএন্ডডি বিভাগ, পদ ।

গোপালগঞ্জে থাকা অবস্থায় স্থানীয় সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম কে খুশী করতে স্ব প্রণোদিত হয়ে নিজ উদ্যেগে বঙ্গবন্ধু গ্যালারি তৈরী করেন। শেখ সেলিম তার এই উদ্যেগে খুশী হয়ে তাকে তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলীর কাছে সুপারিশ করে পদোন্নতি দিয়ে ২০২১ সালের ৭ই জানুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, গণপূর্ত ই/এম ডিজাইন সার্কেল, ঢাকা এই পদে পদায়িত করেন।
নিয়মিত দায়ীত্বের বাইরে অতিরিক্ত যে সমস্ত দায়িত্ব পেয়ে দূর্নীতি ও অনিয়ম করেছেন—
*উত্তরা এপার্টমেন্ট প্রকল্পে- নির্বাহী প্রকৌশলী ( রিজার্ভ) পদে থাকাকালীন দূর্নীতি।
*খুলনা বিভাগীয় কমিশনারের নতুন কার্যালয় এবং অডিটোরিয়াম নির্মান প্রকল্পে লিফট যাচাই বাচাই কারিগরি কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে জার্মানির লিফটের বদলে টাকা খেয়ে চায়না লিফটের অনুমোদন।
*বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সমন্বিত কলকারখানা পরিদর্শন কার্যক্রমের জন্য তাকে ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল সেখান থেকে তিনি স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের আস্থাভাজন হয়ে দূর্নীতির মাধ্যমে শত কোটি টাকার বেশী অবৈধ ইনকাম করেন।
*গণপূর্ত অধিদপ্তরের সিডিউলে সারা বাংলাদেশে অবস্থিত গণপূর্তের অফিসে ওয়ালটন কোম্পানির তৈরি লিফট একচেটিয়া টেন্ডারের মাধ্যমে স্থাপনের জন্য ওয়ালটনের টাকায় ইউরোপ ভ্রমন।
*আজিমপুরে পার্কিং শেড নির্মাণে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত কমিটির (সদস্য সচিব ) খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও খুলনা সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকের ভাতিজা প্রকৌশলী নিয়াজ মোঃ তানভীর আলম কে বাঁচাতে টাকার বিনিময়ে মিথ্যা রিপোর্ট প্রদান।
ভারতে টাকা পাচার (মানিলন্ডারিং):
শেখর চন্দ্র বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ হল মানিলন্ডারিং। দেশের বাহিরে তার প্রচুর অবৈধ সম্পদ রয়েছে। বিশ্বস্থ সূত্র জানিয়েছে, শেখর চন্দ্র বিশ্বাস দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ নামে বেনামে বিনিয়োগের পাশাপাশি হুন্ডির মাধ্যমে পাশের দেশ ভারতে পাচার করেছেন। এক বিশেষ অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোলকাতার রাজারহাট নিউ টাউন এলাকায় প্রকৌশলী শেখর চন্দ্র বিশ্বাস একটি বিলাসবহুল বাড়ী নির্মাণ করেছেন। এই ভবন নির্মাণের সমস্ত টাকা তিনি হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে পাচার করেছেন। এখানেই শেষ নয়, প্রকৌশলী শেখর চন্দ্র বিশ্বাস অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডায়ও বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে ।
জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ:
গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শেখর চন্দ্র বিশ্বাসের বাড়ি সিরাজগঞ্জে হলেও ঢাকায় তিনি গড়ে তুলেছেন একাধিক বাড়ি ও ফ্লাট। বিশেষ অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য মতে, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শেখর চন্দ্র বিশ্বাসের বাবা নিম্ন মধ্যবিত্ত হলেও রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার মোহাম্মদী হাউজিং সোসাইটির ৯ নং রোডের ৫/৭ নং আলিশান বাড়িটি কয়েক কোটি টাকা খরচ করে তৈরী করেছেন। এ ছাড়াও মালিবাগ, ধানমন্ডি এবং বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় রয়েছে তার বিলাসবহুল পাঁচটি ফ্লাট এবং বাড়ী।
গত ৫ই আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমানোর অন্যতম ক্যারিশম্যাটিক কার্যালয়ে পরিণত হওয়া গণপূর্ত ই/এম ডিজাইন সার্কেল, ঢাকার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রয়েছেন শেখর চন্দ্র বিশ্বাস এখনো স্বমহিমায় উদ্ভাসিত।
ছাত্র জনতার এই আন্দোলন নস্যাৎ করতে সড়ক ভবনের নিজ কক্ষেমধ্যরাত পর্যন্ত ছাত্রলীগ আর যুবলীগ নেতাদের সাথে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকতেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শেখর চন্দ্র বিশ্বাস । আর তার সকল অপকর্মে সঙ্গ দিতেন অফিস সহকারি কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক ও হিসাব রক্ষক।
এই অফিস থেকেই তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শেখর চন্দ্র বিশ্বাস প্রতিদিন ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে মহানগর যুবলীগ ও ছাত্রলীগ ক্যাডারদের জন্য শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে পাঠাতেন লক্ষ লক্ষ টাকা।
গত ৫ আগস্ট স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা দিল্লি পালালেও গণপূর্ত ই/এম ডিজাইন সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শেখর চন্দ্র বিশ্বাসের মতো তার দোসররা এখনও দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে ঘাপটি মেরে রয়েছেন। তারা সুযোগ বুঝে লক্ষ্য অর্জনে ছলে বলে কৌশলে এমনকি বিগত সময়ের বিপুল পরিমাণ উপার্জিত অর্থ দিয়ে টার্গেট পূরণেও সক্ষম হচ্ছেন। শেখ হাসিনা পালালেও গণপূর্ত ই/এম ডিজাইন সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আওয়ামী দোসর শেখর চন্দ্র বিশ্বাসের মতো হাসিনার অনেক পেতাত্মা রয়েছেন এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
তারা বিগত সময়ে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট করে বিত্তশালী হয়েছেন। এখন তারাই সেই অর্থ দিয়ে দুর্নীতিবাজদের ম্যানেজ করে ফেলছেন। অন্যদিকে দুর্নীতিবাজরা রাতারাতি ভোল পাল্টিয়েও ফেলেছেন।
বহুল আলোচিত ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা সরকারের বিশ্বস্ত সহচর ও সাবেক ছাত্রলীগ ক্যাডার গণপূর্ত ই/এম ডিজাইন সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আওয়ামী দোসর শেখর চন্দ্র বিশ্বাসের নগ্ন হস্তক্ষেপে দিনাজপুর (সওজ) সড়ক বিভাগে কোটি কোটি টাকার ভয়াবহ লুটতন্ত্র কায়েম করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে, প্রকৌশলী শেখর চন্দ্র বিশ্বাসের ল্যান্ড ফোন ও তার হোয়াটসঅ্যাপে ফোন দেওয়া হলে রিসিভ না করাই তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সংবাদ প্রতিদিন কে বলেন, ‘যারা অতীতে দুর্নীতি করেছেন তাদের তালিকা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এ নিয়ে কাজও শুরু হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত হবে তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
গণপূর্তে দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন সংবাদ প্রতিদিন কে বলেন, ‘ইতোমধ্যে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগের ভিত্তিতে দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। সেখান থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত দুদকের টিম খতিয়ে দেখছে। তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দুদক সেই প্রতিষ্ঠান বা অধিদপ্তরগুলোতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে পরবর্তী পদক্ষেপ নিচ্ছে। আপনাদের মাধ্যমে গণপূর্তের এই প্রকৌশলীর বিষয়ে জানতে পারলাম তাই সুনির্দিষ্ট কোনো দুর্নীতির খবর আমরা সাংবাদিকদের মাধ্যমেও জানতে চাই। এতে আমরা কাজ করতে আরও সুবিধা হবে। সরকারি-বেসরকারি যেকোনো খাত কিংবা ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির খবরকে দুদক খুব গুরুত্বসহকারে নিচ্ছে।’
এই দুর্নীতিবাজ তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তারপূর্বক আইনের আওতায় এনে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন বলে সচেতনমহল মনে করেন।
দীর্ঘদিন যাবৎ সিডিউলের তথ্য ফাঁস, লটারীর নামে নাটক, কমিশন বাণিজ্যে ঠিকাদারদের ৭/৮ জনের ভাগ্য খুলতে সহায়তা করে নিজেও হয়েছেন শত-শত কোটি টাকার মালিক।
দুর্নীতিগ্রস্থ এই তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এখনো কীভাবে গণপূর্ত ই/এম ডিজাইন সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত আছেন তা খতিয়ে দেখতে দুদকের কঠোর হস্তক্ষেপসহ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাননীয় উপদেষ্টা এবং প্রধান প্রকৌশলীর সুদৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন সচেতন মহল।

আপনার মতামত লিখুন