স্ট্রোক দ্রুত চিকিৎসায় বাঁচবে জীবন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের প্রতি চারজনে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি জীবদ্দশায় স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারেন। বেশ কয়েকটি কারণে বাড়ে স্ট্রোকের ঝুঁকি, নিয়ম মেনে জীবন যাপন করলে ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব। দেহের ওপর স্ট্রোকের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কমাতে দ্রুত চিকিৎসার বিকল্প নেই। একমুহূর্ত দেরি হলেও স্থায়ী ক্ষতি, যেমন—প্যারালিসিস হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।সঠিক সময় চিকিৎসা ও পুনর্বাসন নিলে জীবন বাঁচানো এবং স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সম্ভব। অনেকেই স্ট্রোকের চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপির গুরুত্ব অবহেলা করেন, যা একেবারেই অনুচিত। স্ট্রোক প্রতিরোধ ও প্রতিকারে সবার আগে প্রয়োজন এ বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানো, যাতে স্ট্রোক চিকিৎসায় প্রাথমিক প্রতিরোধ ও দ্রুত চিকিৎসার গুরুত্ব বুঝে স্ট্রোকের লক্ষণ শনাক্ত করে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়।
স্ট্রোকের ধরন
মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলের হঠাৎ ব্যাহত হওয়াকেই বলা হয় স্ট্রোক।কারণভেদে এটিকে দুই ধরনে ভাগ করা যায়—
ইস্কেমিক স্ট্রোক (Ischemic Stroke) : মস্তিষ্কের কোনো রক্ত পরিবাহী ধমনি বন্ধ হয়ে গেলে দেখা দেয় ইস্কেমিক স্ট্রোক। মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে দেখা দেয় অক্সিজেনের তীব্র ঘাটতি, যার ফলে মস্তিষ্কের নিউরন কোষগুলো দ্রুত নষ্ট হতে থাকে। চিকিৎসায় দেরি হলে বড় ক্ষতি বা মৃত্যুও হতে পারে।
হেমোরেজিক স্ট্রোক (Hemorrhagic Stroke) : মস্তিষ্কের রক্তনালি কোনো কারণে ফেটে গেলে শুরু হয় রক্তক্ষরণ।এতে মস্তিষ্কে রক্ত জমে গিয়ে নিউরন কোষ ও মস্তিষ্কের আশপাশের সব টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কেন হয় স্ট্রোক
স্ট্রোকের প্রধান কয়েকটি কারণ—
► দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension) থাকলে, বিশেষত অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ বলা যায় স্ট্রোকের মূল কারণ।
► ডায়াবেটিসের প্রভাবেও হতে পারে স্ট্রোক।
► রক্তে উচ্চমাত্রায় কোলেস্টেরল থাকলে।
► ধূমপান ও মদ্যপান করলে।
► অতিরিক্ত মানসিক চাপের প্রভাবেও স্ট্রোক হয়ে থাকে।
► দেহের অতিরিক্ত ওজন স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। অতিরিক্ত ওজন নেই কিন্তু নিষ্ক্রিয় জীবন যাপন করছেন যাঁরা, তাঁরাও আছেন ঝুঁকিতে।
► পরিবারের কারো বা স্ট্রোকের বংশগত ইতিহাস থাকলেও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।
লক্ষণ
স্ট্রোকের প্রাথমিক লক্ষণ মনে রাখার সহজ সূত্র হলো
FAST—
► F (Face) : মুখ বেঁকে যাওয়া।
► A (Arm) : এক বা উভয় হাত দুর্বল হয়ে যাওয়া।
► S (Speech) : কথা জড়ানো বা অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া।
► T (Time) : এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে সময় নষ্ট না করে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া জরুরি।
এ ছাড়া হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, চোখে দেখা কমে যাওয়া, মাথা ঘোরা, ভারসাম্য হারানো, হাত-পা অবশ হয়ে যাওয়া ইত্যাদিও স্ট্রোকের লক্ষণ হতে পারে।
নির্ণয়
স্ট্রোক নির্ণয়ের জন্য সাধারণত সিটি স্ক্যান, এমআরআই, ডপলার আলট্রাসাউন্ডের মতো ইমেজিং পরীক্ষার মাধ্যমে মস্তিষ্কের অবস্থা সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা হয়।
এ ছাড়া রক্ত পরীক্ষা প্রয়োজন হতে পারে। এসব পরীক্ষায় মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বা রক্তক্ষরণ আছে কি না, তা জানা যায়।
চিকিৎসা
ইস্কেমিক স্ট্রোকের চিকিৎসায় রোগীকে রক্ত জমাট ভাঙার ওষুধ (Thrombolytic therapy) দেওয়া হয়। স্ট্রোক হওয়ার তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে না দিলে এটি কাজ করে না। হেমোরেজিক স্ট্রোকে রক্তক্ষরণ বন্ধ ও মস্তিষ্কের চাপ নিয়ন্ত্রণে ওষুধ বা অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হতে পারে। এ ছাড়া রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি।
প্যারালিসিস পুনর্বাসনে ফিজিওথেরাপি
স্ট্রোকের প্রভাবে অনেক রোগীর শরীরের এক পাশ আংশিক বা সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্ত (প্যারালিসিস) হয়ে যায়। দেহের কর্মক্ষমতা ফিরে পেতে ফিজিওথেরাপি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে—
► প্রাথমিক পর্যায়ে : রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখা, জয়েন্টের নড়াচড়া বজায় রাখা এবং পেশির খিঁচুনি (spasticity) প্রতিরোধ।
► পুনর্বাসন পর্যায়ে : রোগীকে ধীরে ধীরে বসা, দাঁড়ানো, হাঁটা, ভারসাম্য রক্ষা ও দৈনন্দিন কাজ শেখানো হয়।
► এক্সারসাইজ ও থেরাপি : প্যাসিভ ও অ্যাক্টিভ এক্সারসাইজ, স্ট্রেচিং, ব্যালান্স ট্রেনিং, গেট ট্রেনিং, ইলেকট্রিক স্টিমুলেশন ও ফাংশনাল থেরাপি রোগীর দ্রুত সুস্থতায় সহায়ক।
► স্পিচ ও অকুপেশনাল থেরাপির সঙ্গে সমন্বয় : কথা ও হাতের সূক্ষ্ম কাজের দক্ষতা ফিরিয়ে আনতে অন্যান্য থেরাপিস্টের সহযোগিতাও অপরিহার্য।
স্ট্রোক প্রতিরোধ করা সম্ভব সঠিক জীবনযাপন, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, ওষুধ সেবন ও ধূমপান ত্যাগের মাধ্যমে। সময়মতো চিকিৎসা ও ধারাবাহিক ফিজিওথেরাপি পুনর্বাসনই স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তিকে নতুন জীবন দিতে পারে।
লেখক : চেয়ারম্যান ও চিফ কনসালট্যান্ট
ঢাকা সিটি ফিজিওথেরাপি হাসপাতাল

আপনার মতামত লিখুন