চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে আবারও দুর্নীতি, পক্ষপাত ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে। বোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইলিয়াস উদ্দিন আহাম্মদ দুর্নীতিবাজ ও বিতর্কিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিতে ছুটির দিনে গোপনে সিলেকশন কমিটির সভা আয়োজন করেছেন-এমন অভিযোগ করেছেন বোর্ডের অভ্যন্তরীণ সূত্রসহ একাধিক কর্মকর্তা। বিধি অনুযায়ী, এ ধরনের সভা আহ্বানের আগে কমপক্ষে তিন কর্মদিবসের নোটিশ দিতে হয় এবং বোর্ড সচিবকে অবশ্যই সভায় উপস্থিত থাকতে হয়। কিন্তু এবারের সভা ডাকা হয়েছে বৃহস্পতিবার, অনুষ্ঠিত হয়েছে শনিবার সকালে, অর্থাৎ মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে, তাও আবার ছুটির দিনে, এবং সবচেয়ে বিস্ময়করভাবে, বোর্ড সচিবকে একেবারেই আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এমন নজিরবিহীন পদক্ষেপে ক্ষোভে ফুঁসছে বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অনেকেই এটিকে ‘দলীয় আনুগত্য রক্ষার পুরস্কার’ হিসেবে দেখছেন।
গোপনীয় তৎপরতায় ছুটির দিনে সভা :
গত শনিবার বেলা ১১টার দিকে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সভাকক্ষে এই সিলেকশন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার মূল আলোচ্যসূচি হিসেবে কয়েকটি সাধারণ প্রশাসনিক বিষয় রাখা হলেও, মূল লক্ষ্য ছিল তিন বিতর্কিত কর্মকর্তার পদোন্নতি অনুমোদন করা, বলছে বোর্ডের অভ্যন্তরীণ সূত্র। এই তিন কর্মকর্তা হলেন- সহকারী সচিব মো. ওসমান গণি, সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. আলী আকবর, এবং সহকারী কলেজ পরিদর্শক আবুল কাশেম মো. ফজলুল হক। বোর্ডের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “সভায় একাধিক এজেন্ডা রাখা হলেও উদ্দেশ্য ছিল একটাই—এই তিনজনকে দ্রুত পদোন্নতি দেওয়া। পদ শূন্য না থাকলেও তাদের ইন-সিটু পদোন্নতির মাধ্যমে (পূর্বের দায়িত্বেই থেকে উচ্চতর পদমর্যাদা ও আর্থিক সুবিধা প্রদান) পুরস্কৃত করার পরিকল্পনা চলছিল।” সূত্র আরও জানায়, এই প্রক্রিয়া নিয়ে সচিব আপত্তি জানাতে পারেন-এমন আশঙ্কাতেই সচিবকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ অধ্যাপক তফজল হক ‘এক্সপার্ট’ সদস্য :
সিলেকশন কমিটিতে ‘এক্সপার্ট’ সদস্য হিসেবে রয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম তফজল হক। তিনি আওয়ামীপন্থী শিক্ষক রাজনীতির একজন সক্রিয় নেতা এবং চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা। পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী নওফেলের ঘনিষ্ঠ হিসেবে তিনি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার পদেও ছিলেন। বোর্ডের কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন, “আওয়ামী ঘরানার শিক্ষক তফজল হককে এই কমিটিতে রাখা হয়েছে নির্দিষ্ট কর্মকর্তাদের পদোন্নতি নিশ্চিত করতে। তিনি আগেও এমন পদোন্নতিতে রাজনৈতিক ভূমিকা রেখেছেন।” সভায় তার উপস্থিতি এবং সচিবের অনুপস্থিতি—এই দুইয়ের সমন্বয়কে অনেকেই ‘চেয়ারম্যানের পরিকল্পিত কৌশল’ বলে মনে করছেন।
শাস্তিপ্রাপ্ত ওসমান গণির পুরস্কারস্বরূপ পদোন্নতি :
সহকারী সচিব মো. ওসমান গণি বোর্ডের অন্যতম বিতর্কিত কর্মকর্তা। তার বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক শাস্তিমূলক রেকর্ড ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ দাখিল, চেক জালিয়াতি, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ঘুষ আদায়সহ নানা অভিযোগে তিনি তিনবার শাস্তি পেয়েছেন। কিন্তু বর্তমান চেয়ারম্যান দায়িত্ব নেওয়ার পর আশ্চর্যজনকভাবে সেই সব শাস্তির আদেশ প্রত্যাহার করে নেন। শুধু তাই নয়, পূর্বে শাস্তির কারণে কর্তিত বেতন ও ভাতার ১৫ লাখ টাকা ফেরত দেয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়। ওসমান গণি রাজনীতিতেও সক্রিয়। তিনি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা মৎস্যজীবী লীগের সদস্য হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দলীয় পদে ছিলেন। বোর্ডের কর্মকর্তাদের দাবি, “চেয়ারম্যান ইলিয়াস উদ্দিন নিজে আওয়ামী ঘরানার হওয়ায় ওসমান গণিকে পুরস্কৃত করতে এই তড়িঘড়ি পদোন্নতির আয়োজন করেছেন।”
আলী আকবর মেয়রের আত্মীয় পরিচয়ে দাপট :
সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. আলী আকবরও কম বিতর্কিত নন। সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর আত্মীয় পরিচয়ে তিনি দীর্ঘদিন বোর্ডে প্রভাব খাটিয়েছেন। পূর্ববর্তী সরকারে শিক্ষামন্ত্রী নওফেলের ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলেও জানা গেছে। বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, “নওফেল মন্ত্রী থাকাকালে আলী আকবর নিয়মিত বোর্ডে ‘দাপুটে কর্মকর্তা’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বিভিন্ন স্কুল ও কলেজ পরিদর্শনে গিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের কাছ থেকে উৎকোচ নিতেন।” বিজি প্রেসে দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে আরও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, যা পরে ধামাচাপা পড়ে যায়। এখন সেই কর্মকর্তা আবারও পদোন্নতির তালিকায় নাম লিখিয়েছেন।
ফজলুল হক অনুমোদন বিকৃতির অভিযোগ :
সহকারী কলেজ পরিদর্শক আবুল কাশেম মো. ফজলুল হকও আলোচিত নাম। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কক্সবাজার-৩ আসনের সাবেক এমপি সাইমুম সরোয়ার কমলের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বর্তমান চেয়ারম্যানের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। বোর্ডের অনুমোদন কমিটির বৈঠকে এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত উল্টে দিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি মাধ্যমে পাঠদানের অনুমোদন দেওয়ার ঘটনায় তার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বোর্ডের এক সদস্য জানান, “চেয়ারম্যান ইলিয়াস উদ্দিনের ছত্রছায়ায় থেকেই ফজলুল হক বহুবার নিয়ম ভেঙে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এবার তারও পদোন্নতি ঠিক করা হয়েছে।”
সচিবকে বাদ দিয়ে সভা :
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড গঠনের পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সিলেকশন কমিটির সভা সচিবকে বাদ দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়নি। সচিবই বোর্ডের প্রশাসনিক প্রধান এবং নিয়ম অনুযায়ী, বোর্ডের যাবতীয় নথি ও সিদ্ধান্ত অনুমোদনের দায়িত্বও তার। অতীতের অভিজ্ঞতায় জানা যায়, বোর্ডে নিয়োগ বা পদোন্নতির যেকোনো প্রক্রিয়ায় সচিবের স্বাক্ষর ছাড়া তা বৈধ হয় না। ফলে সচিবকে বাদ দিয়ে সভা আয়োজনকে অনেকেই দেখছেন ‘ইচ্ছাকৃত আইন ভঙ্গ’ হিসেবে। একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “সচিব সভায় থাকলে এই বেআইনি পদোন্নতির বিরোধিতা করতেন। তাই সচেতনভাবে তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে।”
দলীয় তদবিরে চেয়ারম্যান পদে আসেন ইলিয়াস উদ্দিন :
বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইলিয়াস উদ্দিন আহাম্মদ সম্পর্কেও রয়েছে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার অভিযোগ। শিক্ষাবোর্ডের অভ্যন্তরীণ একাধিক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকার আমলে তিনি বোর্ড চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সাধারণ সম্পাদক এবং উত্তর জেলার সাধারণ সম্পাদকের কাছ থেকে ‘ডিও লেটার’ (প্রস্তাবপত্র) সংগ্রহ করেছিলেন। তখন তিনি নিজেকে দলের নিবেদিতপ্রাণ সমর্থক হিসেবে পরিচয় দিতেন। কিন্তু ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে তিনি ‘নিরপেক্ষ’ পরিচয়ে নতুন চরিত্র ধারণ করেন। বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, “চেয়ারম্যান এখন এমনভাবে নিজেকে উপস্থাপন করছেন যেন তিনি কখনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। অথচ আওয়ামী আমলে তিনি ছিলেন নওফেলপন্থী গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠজন।”
প্রশাসনিক অসঙ্গতি ও আইন লঙ্ঘনের নজির :
শিক্ষা বোর্ডের অভ্যন্তরীণ বিধি অনুযায়ী, সিলেকশন কমিটির সভা আহ্বানের জন্য তিন কর্মদিবসের নোটিশ দিতে হয়। কিন্তু এবার বৃহস্পতিবার নোটিশ জারি করে শনিবার সভা আয়োজন করে সেই বিধি ভঙ্গ করা হয়েছে। এছাড়া ছুটির দিনে বোর্ডের সভা আয়োজন প্রশাসনিকভাবে অনভিপ্রেত ও নিয়মবহির্ভূত। একজন অবসরপ্রাপ্ত বোর্ড কর্মকর্তা বলেন, “ছুটির দিনে কোনো অফিসিয়াল সভা করা মানে সেটা উদ্দেশ্যমূলকভাবে গোপনে করা। এমন সভায় প্রশাসনিক প্রধানকে বাদ দেওয়া এক ধরনের ষড়যন্ত্রই বটে।”
চেয়ারম্যানের ‘নীরবতা’ আরও সন্দেহ বাড়িয়েছে :
বিষয়টি নিয়ে অধ্যাপক ইলিয়াস উদ্দিন আহাম্মদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তার মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি। এমনকি বোর্ডের কার্যালয়েও তার উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। এদিকে বোর্ডের অনেক কর্মকর্তা মনে করছেন, চেয়ারম্যানের এই নীরবতাই প্রমাণ করছে যে অভিযোগের কিছুটা হলেও সত্যতা আছে।
দুর্নীতির চক্রে জড়ানো বোর্ডের সুনাম প্রশ্নবিদ্ধ :
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড দীর্ঘদিন ধরেই অনিয়ম ও দলীয়করণের অভিযোগে জর্জরিত। একসময় পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশে শুদ্ধতা ও স্বচ্ছতার জন্য খ্যাত এই বোর্ড এখন প্রায়ই সমালোচনায় পড়ে। কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক দাসত্ব, দলীয় কোটা ও তদবিরের মাধ্যমে পদোন্নতি এখন ‘অঘোষিত প্রথা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বোর্ডের এক কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “যে কর্মকর্তারা দুর্নীতির দায়ে শাস্তি পেয়েছিলেন, তারাই এখন পুরস্কৃত হচ্ছেন। এতে সৎ কর্মকর্তা অনুৎসাহিত হচ্ছেন এবং বোর্ডের সামগ্রিক প্রশাসন ভেঙে পড়ছে।”
চট্টগ্রামের শিক্ষক সমাজ ও শিক্ষা বোর্ডুসংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। তারা বলেন, “দলীয় বিবেচনায় নয়, মেধা ও সততার ভিত্তিতে পদোন্নতি হতে হবে। না হলে শিক্ষা বোর্ডের প্রতি জনগণের আস্থা পুরোপুরি হারিয়ে যাবে।” চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সাম্প্রতিক এই ঘটনাটি প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের পাশাপাশি এক গভীর রাজনৈতিক রোগের প্রতিচ্ছবি। ছুটির দিনে সচিবকে বাদ দিয়ে সভা ডাকা, শাস্তিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করা এবং একাধিক দলীয় ব্যক্তিকে পদোন্নতির পরিকল্পনা—সব মিলিয়ে এটি একটি প্রণালীগত দুর্নীতির উদাহরণ। যেখানে ক্ষমতা, রাজনীতি ও প্রশাসন একে অপরের সঙ্গে মিশে গিয়ে জনস্বার্থকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনো তদন্ত শুরু না হলে এই অনিয়ম চলতেই থাকবে—এমন আশঙ্কা করছেন বোর্ডের সৎ কর্মকর্তারা।

চট্টগ্রাম ব্যুরো
প্রকাশের সময়: মঙ্গলবার, ৪ নভেম্বর, ২০২৫ । ১:১৮ পূর্বাহ্ণ