ফরহাদ হোসেনের নেতৃত্বে রানা-জাহাঙ্গীর-রুরেল দালাল চক্রে অতিষ্ঠ সিলেট সদর নির্বাচন অফিস

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশের সময়: বৃহস্পতিবার, ৬ নভেম্বর, ২০২৫ । ২:২৮ পূর্বাহ্ণ

জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি নাগরিক জীবনের অপরিহার্য দলিল—ব্যাংক হিসাব খোলা, জমি কেনাবেচা, পাসপোর্ট, ভোটার তালিকা এমনকি চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রেও এটি এখন অপরিহার্য। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ সেবা নিতে গিয়ে সাধারণ মানুষ পড়ছেন সীমাহীন দুর্ভোগে। সিলেট সদর উপজেলা নির্বাচন অফিস ঘিরে গড়ে উঠেছে এক প্রভাবশালী দালালচক্র, যাদের বিরুদ্ধে ঘুষ, অনিয়ম ও প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে বারবার।

রানা, জাহাঙ্গীর ও রুরেল সিন্ডিকেট :
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন অফিসের আশপাশে অবস্থানরত রানা নামে এক দালাল দীর্ঘদিন ধরে এনআইডি সংশোধন, পুনঃপ্রদান ও দ্রুত কার্ড সরবরাহের নামে অর্থ আদায় করে আসছে। রানার সঙ্গে অফিসের ভেতরে যোগসাজশে কাজ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে কর্মচারী জাহাঙ্গীর ও রুরেল নামে দুই জনের বিরুদ্ধে। আবেদনকারীর ফাইল আটকে রাখা, অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করানো এবং “ম্যানেজ খরচ” নামে অর্থ আদায়—সবকিছুই চলে তাদের মাধ্যমেই। একাধিক ভুক্তভোগীর দাবি, এই তিনজনের কার্যক্রমে নির্বাচন অফিস কার্যত দালালনির্ভর বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

প্রবাসীদের ঘাড়ে দুর্ভোগ :
প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট অঞ্চলে এনআইডি সংশোধন ও পুনঃপ্রদানের চাহিদা বেশি। যুক্তরাজ্যপ্রবাসী মনোয়ারা খাতুন জমির কাগজপত্র ঠিক করতে দেশে এসে এই চক্রের ফাঁদে পড়েন। তিনি জানান, “রানা নামে এক লোক এসে বলল, ভেতরের লোকজনকে ম্যানেজ না করলে মাসের পর মাস লেগে যাবে। বাধ্য হয়ে দশ হাজার টাকা দিয়েছি। তিন দিনের মধ্যে কপি এনে দিল, কিন্তু জানি না নিয়মমাফিক হয়েছে কিনা।” একইভাবে কুয়েতপ্রবাসী শাহিন আহমদ বলেন, “চার দিন ঘুরেও কাজ হয়নি। শেষে এক দালালকে আট হাজার টাকা দিতে বাধ্য হয়েছি।”

ফরহাদ হোসেনের নেতৃত্বে সক্রিয় দালালচক্র :
স্থানীয়দের অভিযোগ, উপজেলা নির্বাচন অফিসার মো. ফরহাদ হোসেনের অবহেলা ও দুর্বল নজরদারির সুযোগে এই দালালচক্র দীর্ঘদিন ধরে বেপরোয়াভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অফিসের সামনে প্রতিদিন রানা ও তার সহযোগীরা প্রকাশ্যে অবস্থান করে আবেদনকারীদের ধরছে, টাকা নিচ্ছে—কিন্তু প্রশাসনিক কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, কর্তৃপক্ষ এদের কার্যক্রম সম্পর্কে জানে, তবুও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা স্বীকার করেন, “দালালরা সুযোগ নেয়। কিছু কর্মচারীও এতে জড়িত থাকে। জনবল সীমিত হওয়ায় অফিসে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়।”

তিন ধাপে চলে দালালদের বাণিজ্য :
স্থানীয় সূত্রে দালালচক্রের কার্যক্রম তিন ধাপে পরিচালিত হয়-

প্রথম ধাপ: অফিসের বাইরে অবস্থান করে আবেদনকারীর সমস্যা জেনে দ্রুত সমাধানের প্রস্তাব দেওয়া।
দ্বিতীয় ধাপ: ভেতরের কর্মচারীর মাধ্যমে ফাইল অগ্রাধিকার পাওয়া বা আটকে রাখা।
তৃতীয় ধাপ: ‘ম্যানেজ খরচ’ নামে টাকা লেনদেন, যার একটি অংশ জাহাঙ্গীর-রুরেলদের মাধ্যমে অফিসের ভেতরে পৌঁছে যায় বলে অভিযোগ।

আরও উদ্বেগজনক অভিযোগ হলো, এই দালালচক্রের মাধ্যমে ভুয়া এনআইডিও তৈরি হচ্ছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কিছু রোহিঙ্গা ও অননুমোদিত ব্যক্তি টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশি এনআইডি পাচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “এটি শুধু দুর্নীতি নয়, জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও বড় হুমকি।”

অফিসের ভেতরে বিশৃঙ্খলা ও সার্ভার অজুহাত :
সিলেট সদর উপজেলা নির্বাচন অফিসে গিয়ে দেখা গেছে, সকাল থেকেই শতাধিক মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে। কেউ বলছেন সার্ভার কাজ করছে না, কেউ অফিসারের অপেক্ষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছেন। এ সময় কয়েকজন দালাল প্রকাশ্যে আবেদনপত্র পূরণ ও ‘দ্রুত কাজ করে দেওয়ার’ প্রস্তাব দিতে দেখা যায়।
মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, “প্রবাসীরা বৈদেশিক মুদ্রার বড় উৎস। তাদের হয়রানি মানে অর্থনীতিকে আঘাত করা। দালালচক্রের বিরুদ্ধে তদন্ত ও জবাবদিহি জরুরি।” তিনি আরও বলেন, “প্রযুক্তিনির্ভর সেবাকাঠামো গড়ে না তুললে এই চক্র থামবে না।”

সিলেট জেলা নির্বাচন অফিসের সিনিয়র জেলা নির্বাচন অফিসার মো. মুঞ্জুরুল আলম বলেন, “আমরা দালালদের প্রশ্রয় দিই না। কেউ প্রতারিত হলে লিখিত অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তবে স্থানীয়দের দাবি, “মাঠ পর্যায়ে বাস্তব ব্যবস্থা না নিলে কোনো পরিবর্তন হবে না।” সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, “প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকায় কিছু কর্মচারী আর্থিক সুবিধা নিয়ে দালালদের মাধ্যমে কাজ করায়—এমন অভিযোগ বহুদিনের। প্রশাসন চাইলে এদের চিহ্নিত করা কঠিন নয়।” রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের প্রতীক এনআইডি আজ দালালদের কবলে বন্দি। রানা, জাহাঙ্গীর ও রুরেলের মতো ব্যক্তিরা সরকারি সেবাকে বাণিজ্যে পরিণত করেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, উপজেলা নির্বাচন অফিসার মো. ফরহাদ হোসেনের অবহেলা ও দুর্বল তদারকির কারণে এই চক্র দীর্ঘদিন ধরেই সক্রিয়।
প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থাপনা ও কঠোর প্রশাসনিক অভিযান ছাড়া দালালচক্রের এই দৌরাত্ম্য বন্ধ করা সম্ভব নয়।

  কপিরাইট © দূর্নীতির ডায়েরি সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত

প্রিন্ট করুন