ঢাকা ওয়াসায় নিয়োগ, বদলি এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনিয়ম ও আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ নতুন করে মুখে মুখে ঘুরছে। সংস্থাটির সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তা মশিউর রহমান খানের বিরুদ্ধে বেশ কিছু কর্মচারী ও শ্রমিক নেতারা নিয়োগ-বাণিজ্য, বদলি-লেনদেন এবং অভ্যন্তরীণ আইনি নিষ্পত্তি প্রক্রিয়ায় পক্ষপাতের অভিযোগ তুলেছেন। সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি—এই অনিয়মের ফলে ওয়াসার বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ ব্যাহত হচ্ছে, কর্মপরিবেশে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে এবং প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক উত্তরাধিকার নীতিতে আস্থা হ্রাস পাচ্ছে।
এ বিষয়ে ওয়াসার ভেতরের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে আউটসোর্সিং নিয়োগ থেকে শুরু করে বিভাগের বদলি আদেশ পর্যন্ত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত আর্থিক বিনিময়ের শর্তে স্বাক্ষরিত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও সচিব বা ওয়াসার কোনো দায়ী কর্মকর্তা এখনো এসব অভিযোগ সুনির্দিষ্টভাবে স্বীকার করেননি। তারা জানিয়েছেন—“সমস্ত নিয়োগ স্থানীয় সরকার বিভাগের অনুমোদিত কাঠামো অনুযায়ী হয়েছে”।
আউটসোর্সিং নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ : গত এক বছরে ওয়াসায় ৩০০-এর বেশি আউটসোর্সিং নিয়োগ দেওয়া হয়। শ্রমিক ইউনিয়নের বেশ কয়েকজন সক্রিয় সদস্য অভিযোগ করেন, প্রতিটি নিয়োগে ৫ লাখ থেকে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত আর্থিক লেনদেনের শর্ত দেওয়া হয়েছিল। সংগঠনের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন- “নিয়োগের প্রক্রিয়া আগে তালিকা করা, পরে ‘শর্ত মানলে’ যোগদানের অনুমতি—এভাবে চলে। এ জন্য প্রভাবশালী কয়েকজন মধ্যস্থতাকারী থাকে।” তারা দাবি করেন, যেসব নিয়োগে সুপারিশের কথা বলা হয়, সেখানে আসলে সুপারিশ-প্রক্রিয়া ব্যবহৃত হচ্ছে টাকার লেনদেনকে গোপন রাখার জন্য।
বদলি ও প্রশাসনিক আদেশে অসঙ্গতি : ওয়াসার ওয়েবসাইটে দেখা যায় — মাঝে মাঝে বদলি আদেশ দেওয়া হচ্ছে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই তা বাতিল করা হচ্ছে। কিছু কর্মকর্তা জানান, এধরনের ঘটনা কখনও প্রকৃত কারণ জানার আগেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার তাড়াহুড়ো কিংবা আর্থিক লেনদেনের শর্ত পাল্টে যাওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে।
একজন কর্মকর্তার ভাষ্যে-“একজন কর্মকর্তা নতুন কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার আগেই আবার নতুন বদলি আদেশ দেওয়া হয়। এটি স্বাভাবিক প্রশাসনিক প্রক্রিয়া নয়।” এ বিষয়ে সচিবের অফিস সূত্র দাবি করে, অনেক সময় “তথ্য যাচাই ও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ বিবেচনায়” আদেশ বাতিল করা হয়।
বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তি ও অভিযোগ : আরেকটি আলোচিত অভিযোগ হলো—চলমান বিভাগীয় মামলার নিষ্পত্তিতে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ। কোনো কোনো কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, বড় অংকের অর্থ প্রদান করলে মামলার জটিলতা দ্রুত নিষ্পত্তি করা হয়। অন্যদিকে, যাঁরা অর্থ দিতে অস্বীকৃতি জানান, তাঁদের বদলির মতো প্রশাসনিক চাপের মুখে পড়তে হয়।
একজন কর্মচারী বলেন-“যে মামলা বছরের পর বছর ঝুলে ছিল, কিছু দিনে নিষ্পত্তি হয়ে যায়। আবার যারা অর্থ দিতে পারে না তাদের বিরুদ্ধে নতুন তদন্ত বা নোটিশ আসে।” তবে সচিবালয় সূত্র দাবি করেছে—এই অভিযোগগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং বিভাগীয় মামলার নিষ্পত্তি সর্বদা প্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলা বিধি অনুযায়ী করা হয়।
মাস্টার রুলস কর্মচারীদের স্থায়ীকরণে হতাশা : মাস্টার রুলসে কর্মরত শতাধিক কর্মচারীর স্থায়ী পদে যোগদানের বিষয়ে আদালতের রায় থাকলেও বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের অভিযোগ—স্থায়ী পদে যোগদানের প্রক্রিয়ায়ও “শর্ত ও অনানুষ্ঠানিক দাবি” রয়েছে।
একজন কর্মচারী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন- “আমরা মামলায় জিতেছি। কিন্তু কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা পেতে হলে যদি নতুন করে অর্থ দিতে হয়—তাহলে লড়াই করার মানে কি?” এই কর্মচারীরা জানান—তারা আদালতের আদেশ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন হলে পুনরায় আইনি লড়াই করবেন।
প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা : ওয়াসার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প চলমান রয়েছে। প্রকল্পগুলোর সময়মত সম্পন্ন, ক্রয় প্রক্রিয়া, সরঞ্জাম আমদানি এবং মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা—সবকিছুই প্রশাসনিক স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভরশীল। কর্মকর্তাদের অনিয়মিত বদলি ও কর্মচারীদের অসন্তোষ প্রকল্প অগ্রগতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
এক প্রকৌশলী জানান-“সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত না হলে সরঞ্জাম আমদানি, টেন্ডার ও মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম সবকিছু ব্যাহত হয়। এতে জনসেবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”
বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও কিছু কর্মকর্তা নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানাচ্ছেন। তারা বলছেন, অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে যথাযথ প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
শ্রমিক ইউনিয়নের একজন সিনিয়র সদস্য বলেন “আমরা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু নীতি ও স্বচ্ছতা রক্ষার জন্য কথা বলছি। তদন্ত হলেই প্রমাণ বের হয়ে আসবে।”
ঢাকা ওয়াসা রাজধানীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেবামুখী প্রতিষ্ঠান। এখানে প্রশাসনিক অনিয়ম বা ক্ষমতার অপপ্রয়োগের অভিযোগ যদি সত্য হয়, তবে তা সরাসরি নাগরিক সেবাকে প্রভাবিত করে। এ অভিযোগগুলো এখন পর্যবেক্ষণ ও তদন্তের দাবি তুলছে।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষ চাইলে নথিভিত্তিক অডিট, অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক অনুসন্ধান এবং সাক্ষাৎকারভিত্তিক সত্য যাচাই শুরু করতে পারে।
সঠিক তদন্তই প্রমাণ করবে এই অভিযোগগুলো কতটা সত্য, কতটা রাজনৈতিক বক্তৃতা বা অভ্যন্তরীণ অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ।

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশের সময়: শুক্রবার, ৭ নভেম্বর, ২০২৫ । ১১:৫৬ অপরাহ্ণ