বান্দরবানের জেলা পরিষদ সদস্য লাল জারলম বমের বিরুদ্ধে ৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ

বান্দরবান প্রতিনিধি
প্রকাশের সময়: শনিবার, ৮ নভেম্বর, ২০২৫ । ১২:০৬ পূর্বাহ্ণ

বান্দরবানের আলোচিত সংগঠক ও জেলা পরিষদের সদস্য লাল জারলম বমের বিরুদ্ধে এবার উঠেছে মৌলিক স্বাক্ষরতা প্রকল্পের কোটি টাকার আত্মসাতের গুরুতর অভিযোগ।
শিক্ষক–সুপারভাইজারদের জন্য বরাদ্দ করা সরকারি অর্থের মধ্যে প্রায় ৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও অফিস সরঞ্জামের বরাদ্দ আত্মসাৎসহ একাধিক আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে তোলপাড় শুরু হয়েছে জেলায়।
সরকারের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মৌলিক স্বাক্ষরতা প্রকল্প (৬৪ জেলা) দেশের নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আনতে ২০১৮ সালে চালু করা হয়।
প্রকল্পটির আওতায় বান্দরবানের রুমা, থানচি ও আলীকদম উপজেলায় ৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় — প্রতি উপজেলায় ৩ কোটি টাকা করে।

স্থানীয় এনজিও কমিউনিটি অ্যাডভান্সমেন্ট ফোরাম (CAF) প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায়, যার নির্বাহী পরিচালক ছিলেন লাল জারলম বম, বর্তমানে বান্দরবান জেলা পরিষদের সদস্য।

প্রকল্পের অধীনে প্রতিটি উপজেলায় কয়েকশ’ শিক্ষক ও সুপারভাইজার নিয়োগ করা হয়, যাদের মাধ্যমে নিরক্ষর জনগণকে স্বাক্ষরতা শিক্ষা দেওয়ার কথা ছিল।
তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে আলীকদমে ৬০০ শিক্ষক ও ১৩ জন সুপারভাইজার এবং ২০১৮ সালে রুমায় ১,০২০ জন শিক্ষক ও ১৫ জন সুপারভাইজার ও থানচিতে ১,০০০ শিক্ষক ও ১৫ জন সুপারভাইজারের জন্য ছয় মাসের ভাতা বরাদ্দ ছিল।

কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, রুমা ও থানচি উপজেলায় মাত্র দেড় মাসের ভাতা প্রদান করে বাকি অর্থ ভুয়া স্বাক্ষর, জাল কাগজপত্র ও কল্পিত তালিকার মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়।

সূত্রমতে, এই দুই উপজেলার ভাতা বাবদ মোট বরাদ্দ ছিল প্রায় ৬ কোটি টাকা, যার মধ্যে প্রায় ৪ কোটি টাকাই শিক্ষক ও সুপারভাইজারদের না দিয়েই আত্মসাৎ করা হয়।
এ ছাড়া অফিস সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্য বরাদ্দ ১ কোটি ২৮ লাখ টাকাও বিতরণ করা হয়নি — বরং সম্পূর্ণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ ঘটনায় বিভিন্ন সময় তদন্ত কমিটি গঠন হলেও কার্যত কোনো ফল হয়নি।
তাদের অভিযোগ, তৎকালীন মন্ত্রী বীর বাহাদুর, তার সহধর্মিণী মেহ্লা প্রু এবং  সাবেক জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের সদস্যদের প্রত্যক্ষ প্রভাবে তদন্ত প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়।

তাদের প্রভাবের কারণে প্রশাসনও নিরব ভূমিকা পালন করে, এমনকি মামলা করার প্রস্তুতি নিলেও মন্ত্রী পরিবারের হস্তক্ষেপে মামলা দায়ের করা সম্ভব হয়নি।

একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,

তদন্ত শুরু হলেই ওপর মহল থেকে ফোন আসে। যারা তথ্য দিত, তাদের ওপর চাপ তৈরি করা হতো। এতে করে প্রকৃত অপরাধীরা এখনো নিরাপদে।
বান্দরবান জেলা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর সহকারী পরিচালক মো. মঞ্জুর আহমেদ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন — রুমা, থানচি ও আলীকদমে মোট ৯ কোটি টাকার বরাদ্দ ছিল। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে স্থানীয় এনজিও কমিউনিটি অ্যাডভান্সমেন্ট ফোরাম (CAF), যার নির্বাহী পরিচালক ছিলেন লালজারলম বম। রুমা ও থানচির শিক্ষকদের ছয় মাসের বেতনের মধ্যে মাত্র দেড় মাসের বেতন পরিশোধ করা হয়। বাকি টাকাগুলো আত্মসাৎ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন,
তদন্তের সময় লালজারলম বম কখনো উপস্থিত হননি। বরং তিনি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তদন্ত প্রক্রিয়া ব্যাহত করেন। এমনকি পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠন কুকি–চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (KNF)–এর মাধ্যমে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়।

আরো উল্লেখ্য,সরকারি প্রকল্প ছাড়াও Presbyterian Church in Bangladesh–এর বান্দরবান লোকাল চার্চের নামে বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৬,৩৯১ মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় সাত লাখ টাকা) ইউসিবি ব্যাংকের একটি নির্দিষ্ট হিসাবে লাল জারলম বমমের নামে স্থানান্তর হয়।

স্থানীয়দের দাবি, এই অর্থও প্রকৃত খাতে ব্যবহৃত না হয়ে ব্যক্তিগতভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, যা নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে।

একজন স্থানীয় সমাজকর্মী বলেন,
বিদেশি অনুদানের টাকাগুলোও ঠিক যেভাবে শিক্ষক–শিক্ষিকাদের বরাদ্দ আত্মসাৎ করা হয়েছে, সেভাবেই প্রভাবশালী মহল ভোগ করছে। তদন্ত হলে আরও বড় দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আসবে।
এ বিষয়ে জানতে লালজারলম বমের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি।
এছাড়া তার কার্যালয় থেকেও কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
জেলায় এ ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। স্থানীয় শিক্ষক সমাজ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নাগরিক সংগঠনগুলো বলছে,
যে ব্যক্তি সরকারি টাকা আত্মসাৎ করে শিক্ষা প্রকল্প ধ্বংস করেছে, তাকে জেলা পরিষদের সদস্য করা প্রশাসনের চরম ব্যর্থতা।

আরেকজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বলেন,
যাদের নামে বরাদ্দ ছিল, তারা অনেকেই ভাতা পাননি। অথচ রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, সব ভাতা প্রদান সম্পন্ন! এটি পরিকল্পিত প্রতারণা।

বান্দরবানের সচেতন নাগরিক সমাজ এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে দ্রুত বিচারিক তদন্ত ও লালজারলম বমসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের দাবি জানিয়েছে।
তাদের মতে, যদি এই অর্থ আত্মসাতের ঘটনা প্রমাণিত হয়, তবে এটি শুধু দুর্নীতি নয়, বরং শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা।

  কপিরাইট © দূর্নীতির ডায়েরি সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত

প্রিন্ট করুন